ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা
ভূমিকা:
ভারতবর্ষ একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ। বিশাল আয়তন, বিপুল জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক বৈচিত্রের কারণে ভারতবর্ষকে উপ- মহাদেশ বলা হয়। অষ্টম শতাব্দির শুরুর দিকে এ উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে মুসলিম বিজয়ের সূচনা হয়। মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের সার্বিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। তৎকালীন সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে অনৈক্য ও সামাজিক বৈষম্য ছিল বেশ প্রকট। ভারতে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন রাজা। জৈন, বৌদ্ধ ও হিন্দু- এই তিন ধর্মে বিশ্বাসী ছিল ভারতীয়রা। শিক্ষা-দীক্ষা ও কৃষ্টি-সভ্যতায় সে যুগে ভারতে যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে ও হিমালয় পর্বতমালার পূর্ব পাদদেশে অবস্থিত ভারতে বহু জাতি, ধর্ম ও ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মহামিলন ঘটেছে। ভারতবর্ষ হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রধান দেশ হওয়ায় আরব মুসলমানরা ভারতকে ‘হিন্দুস্তান' নামে আখ্যা দিয়েছিল এবং এ নামটি এখনো প্রচলিত ।
এই ইউনিটের পাঠসমূহ:
পাঠ- ১ : মুসলিম বিজয়ের পূর্বে ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা
পাঠ- ২ : মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু ও মুলতান বিজয়: কারণ, ঘটনা ও ফলাফল
পাঠ- ৩ : সুলতান মাহমুদ: সামরিক অভিযান, চরিত্র ও কৃতিত্ব
পাঠ- ৪ : মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘোরির উত্তর ভারত অভিযান: তরাইনের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধ
পাঠ- ৫ : মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘোরির চরিত্র ও কৃতিত্ব
পাঠ-১.১
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
ভারতের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবেন; মুসলিম আগমনের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের কেন্দ্রিয়, প্রাদেশিক ও গ্রাম পর্যায়ে শাসন ব্যবস্থার ধারণা পাবেন ও
ভারতের তৎকালীন রাজনীতি ও স্বাধীন রাজ্যগুলো সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, উপারিক, বিষয় ও পঞ্চায়েত
ভূমিকা: প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐশ্বর্যে ভরপুর ছিল ভারতবর্ষ। মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষে প্রধানত: তিনটি ধর্ম প্রচলিত ছিল। এগুলো হল বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং হিন্দু ধর্ম। প্রাক-মুসলিম যুগে ভারতবর্ষের শাসন ব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন প্রধান এবং সকল ক্ষেত্রে তাঁর মতামতই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হত। রাজার হাতে ন্যস্ত ছিল আইন প্রণয়ন, ক্ষমতার বন্টন, শাসন পরিচালনা এবং সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের চূড়ান্ত এখতিয়ার। রাজা হর্ষবর্ধন (মৃত্যু ৬৪৫খ্রি.) এর মৃত্যুর পর ভারতবর্ষ রাজনৈতিক বিশৃংঙ্খলায় পতিত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ বিশৃংঙ্খলা ও নৈরাজ্যময় অবস্থা মুসলিম বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল । মুসলিম বিজয়ের সময় উত্তর-পশ্চিম ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ সময় ভারতবর্ষের কেন্দ্রিয় শাসন ও সামাজিক অবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। জাতিভেদ প্রথা হিন্দুসমাজের ঐক্য ও সংহতির মূলে প্রবল আঘাত হানে।
ধর্মীয় ও প্রশাসনিক অবস্থা
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে হিন্দুধর্ম দেশের প্রধান ধর্ম হিসেবে পরিণত হয়। অধিকাংশ রাজাই ছিলেন হিন্দু এবং তারা সকলেই হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সমাজে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের অপ্রতিহত প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিদ্যমান ছিল । ধর্মীয় ব্যাপারে ও শাসনকার্যে তাদের অধিকার ছিল একচেটিয়া। বৈশ্য ও শূদ্রগণ ছিল নির্যাতিত, নিষ্পেষিত এবং নিম্ন শ্রেণির হিন্দুরা ছিল অস্পৃশ্য। ব্রাহ্মণগণ ধর্মীয় ব্যাপারে সর্বেসর্বা ছিলেন। মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষে ধর্মীয় অসন্তোষ, অরাজকতা ও নৈরাজ্য চরম আকার ধারণ করে। সাম্প্রাদায়িক কলহ ও ধর্মীয় কোন্দল মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল । প্রাক-মুসলিম যুগে বংশানুক্রমিকভাবে ভারতবর্ষের রাজা নিযুক্ত হতেন। রাজকুমারীগণও শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতেন বলে জানা যায়। রাজার হাতেই ছিল সমস্ত ক্ষমতা। তিনি আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ন্যায় বিচারের উৎস এবং প্রধান সেনাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি রাজধর্মের আলোকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। রাজকার্য পরিচালনার ব্যাপারে মন্ত্রীগণ রাজাকে পরামর্শ দিতেন এবং সাহায্য করতেন। তবে রাজা তাঁদের পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য ছিলেন না। এ সময় সাম্রাজ্য বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রাদেশিক প্রধানকে বলা হত ‘উপারিক’। তাঁর প্রধান কর্তব্য ছিল প্রদেশের শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা করা রাজার আদেশকে কার্যকরী করা এবং প্রয়োজনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা। প্রদেশগুলি জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলাকে বলা হত ‘বিষয়’। জেলার শাসনকর্তা বিষয়পতি নামে অভিহিত হতেন। দেশের শাসন ব্যবস্থার সর্বনিম্নস্তরে ছিল গ্রাম। গ্রামের শাসন ব্যবস্থা মোড়ল বা পঞ্চায়েত কর্তৃক সম্পাদিত হত।
অর্থনৈতিক অবস্থা
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ ছিল ভারতবর্ষ। এ দেশের মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ। অভিজাত ও উঁচু শ্রেণির অধিকাংশ লোক বিলাসবহুল জীবন যাপন করত। প্রাচীন অর্থশাস্ত্রবিদ কৌটিল্যের বিবরণ অনুযায়ী তিনটি মূখ্য উৎস থেকে রাষ্ট্রের আয় ছিল: ক) ভূমি রাজস্ব, খ) সামন্ত প্রভু ও জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত কর, এবং গ) আবগারী ও বাণিজ্য শুল্ক। পরবর্তীতে এদেশে শিল্পের
ব্যাপক প্রসার ঘটে। গুজরাট ও বাংলা কার্পাস বস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বিখ্যাত ছিল। ব্যবসায়-বাণিজ্যেও উৎকর্ষ সাধিত হয়। বিভিন্ন পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হতে থাকে। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো ছিল বলে এদেশে সংস্কৃতি ও সভ্যতার চরম বিকাশ ঘটেছিল। চীনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বর্ণনা থেকে পঞ্চম শতাব্দির শুরুতে ভারতবর্ষের উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মগধের লোকেরা ধনী ও সমৃদ্ধশালী ছিল । পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর বর্ণনায় জানা যায় যে, সপ্তম শতাব্দিতেও ভারতবর্ষের অধিবাসীগণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত ও নির্বিঘ্নে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। এদেশের অতুল ঐশ্বর্যে আকৃষ্ট হয়ে বিদেশী বণিকগণ যেমন এদেশে বারবার এসেছেন আবার বিদেশী আক্রমণকারীগণও এ দেশ বার বার লুণ্ঠন করে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াস চালিয়েছেন।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
তৎকালীন হিন্দু সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চারটি বর্ণ স্তরে বিভক্ত ছিল। সমাজে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের অপরিসীম প্রভাব বিস্তৃত ছিল। আর বৈশ্য ও শুদ্রদের অবস্থান ছিল সমাজের নিম্নস্তরে। শুদ্রদের সমাজে অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হত। জাতিভেদ প্রথা খুব কঠোর ছিল। জনসাধারণ স্ব স্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ করতে পছন্দ করত। ব্রাহ্মণরা শিক্ষা, ধর্মকর্ম, আচার অনুষ্ঠান ছাড়াও কখনো কখনো যুদ্ধ বিগ্রহে নিয়োজিত থাকতো। ক্ষত্রিয়গণ যুদ্ধ বিগ্রহ, বৈশ্যরা ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং শূদ্রগণ কৃষিকাজ ও সাধারণ কাজ কর্ম করত। বর্ণপ্রথার কারণে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব ছিল। সমাজে বহু বিবাহ, সতীদাহ ও সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল না। নারীরা অন্ত:পুরে জীবন যাপন করতেন। তাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ছিল না। দাসপ্রথা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়। এতদ্বসত্ত্বেও অভিজাত শ্রেণির মেয়েরা উদার শিক্ষা লাভ করত। তারা শাসন ক্ষেত্রে ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করত। মুসলিম বিজয়ের পূর্বে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রভূত অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলা চর্চায় ভারতীয়গণ কৃতিত্ব অর্জন করেন। সে যুগে ভারতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। ভারতের স্বনামধন্য বল্লভী এবং বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উদন্তপুর, বিক্রমশীলা, বারানসী প্রভৃতি স্থানে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল। মালব ও আজমীরে সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। জ্যোর্তিবিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন ও সাহিত্য প্রভৃতি জ্ঞানের চর্চা করা হত । সে যুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল।
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা:
আফগানিস্তান, কাশ্মীর ও কনৌজ
মৌর্য বংশের শাসনামল থেকেই আফগানিস্তান ছিল ভারতের একটি অংশ। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এটিকে হিন্দুশাহী রাজ্য বলে অভিহিত করেন। সপ্তম শতাব্দিতে কর্কট রাজবংশীয় দুর্লভ বর্ধনের অধীনে কাশ্মীর ছিল উত্তর ভারতের অপর একটি স্বাধীন রাজ্য। বিজেতা, বিদ্যোৎসাহী ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় ছিলেন কাশ্মীরের রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর। তিনি কনৌজ, কামরূপ, কলিঙ্গ ও গুজরাট জয় করেন বলে জানা যায়। কর্কট বংশের অপর একজন শাসক জয়পীড় গৌড় ও কনৌজের নৃপতিদের পরাজিত করেন। অষ্টম শতাব্দির প্রথম দিকে কনৌজ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপুর্ণ রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হত। উত্তর-ভারতের অন্যতম পরাক্রমশালী রাজা যশোবর্মণ কনৌজের হৃত গৌরব ও আধিপত্য পুনরুদ্ধার করেন। তিনি গৌড় জয় করে এর রাজাকে হত্যা করেন এবং কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্যের সহায়তায় তিব্বত অভিযান করেন। তিনি চীনে দূত প্রেরণ করেন। কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক তিনি পরাজিত ও নিহত হন। যশোবর্মণ, সিন্ধুরাজ দাহিরের সমসাময়িক ছিলেন। অত:পর অষ্টম শতকের প্রথম দিকে কনৌজে গুরজর-প্রতিহার রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
সিন্ধু ও মালব-দিল্লি ও আজমীর
সপ্তম শতকে সিন্ধু ছিল হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভূক্ত। পরবর্তীতে ‘চাচ’ নামক সিন্ধুর জনৈক ব্রাহ্মণ মন্ত্রী সিন্ধুতে স্বাধীন রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। চাচের পুত্র রাজা দাহিরকে পরাজিত করে ইমাদউদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাশিম ৭১২ সালে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এ রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। প্রতিহার রাজপুতদের দ্বারা শাসিত মালব ছিল উত্তর- ভারতের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। উজ্জয়িনী ছিল এ রাজ্যের রাজধানী। দ্বাদশ শতকে মুসলিম অভিযানের প্রাক্কালে দিল্লি ও আজমীরে শক্তিশালী চৌহান বংশীয় রাজপুত্রগণ রাজত্ব করত। এ বংশের শাসক বিশালদেব চৌহান প্রতিহর বংশের নিকট
পাঠ-১.২
মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু ও মুলতান বিজয়: কারণ, ঘটনা ও ফলাফল
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
সিন্ধুর তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও আরবদের সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন; মুহম্মদ বিন কাসিমের সৈন্য বাহিনীর সিন্ধু ও মুলতান বিজয় সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন ও
সিন্ধু বিজয়ের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ফলাফল সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
দেবল বন্দর, 'বালিস্ত', রণকৌশল ও জহরব্রত
ভূমিকা: আরব বণিকগণ ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে ব্যবসায় বাণিজ্য করতো। আরবে ইসলামের আবির্ভাবের পরও এই ধারা অব্যাহত থাকে। আরব নাবিকদের অনেকেই এ উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। স্থানীয় রমণীদের সাথে তাদের বিয়ে-সাদীও হয়। ইসলামের আবির্ভাবের এক শতাব্দি পর ভারতে মুসলমান শাসনের গোড়াপত্তন হয়। উমাইয়া বংশের খলিফা প্রথম ওয়ালিদ তখন আরব জাহানের খলিফা। তাঁর অধীনে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে হাজ্জাজের নির্দেশে মুসলমানগণ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সিন্ধু ও মুলতান অধিকার করে। এরপর পর্যায়ক্রমে ভারতে স্থায়ী। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
সিন্ধু অভিযানের কারণসমূহ
তৎকালীন ভারতের সিন্ধু ও মুলতানের রাজা ছিলেন দাহির। আরব সাম্রাজ্যের খলিফা ছিলেন প্রথম ওয়ালিদ। আরব সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ইরাক প্রদেশের গভর্ণর ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সিন্ধু ও মুলতানের সাথে আরব শাসনের সাধারণ সীমান্ত ছিল। নানা কারণে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও রাজা দাহিরের মধ্যে মতপার্থক্য হয়। এ কারণে হাজ্জাজ ভারতের সিন্ধু জয় করার জন্য তাঁর জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র ইমাদউদ্দিন মুহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে এক বিজয় অভিযান প্রেরণ করেন।
পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণসমূহ: সিন্ধু বিজয়ের পরোক্ষ কারণসমূহের মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ এবং
প্রত্যক্ষ কারণের মধ্যে ছিল জলদস্যুদের দ্বারা আরব বণিকদের জাহাজ লুন্ঠন।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ
ভারত ধন-ঐশ্বর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। আরবদের সিন্ধু অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ধনরত্ন লাভ করা। রাজা দাহিরের রাজ্য ও আরব সাম্রাজ্যের মধ্যে সীমান্ত অভিন্ন হওয়ায় দুই রাজ্যের মধ্যে প্রায়ই মতানৈক্য ও মতবিরোধ সৃষ্টি হতো এবং সীমান্ত সংঘর্ষ লেগেই থাকত। হাজ্জাজ ছিলেন কঠোর প্রকৃতির শাসক। আইনের শাসন এড়িয়ে হাজ্জাজের অঞ্চল থেকে অনেক অপরাধী রাজা দাহিরের রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। এ সকল কারণে রাজনৈতিক তিক্ততা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। এই সময় সিন্ধুতে চলছিল রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। দাহির ছিলেন অত্যাচারী শাসক। নিম্নশ্রেণির লোকেরা ছিল অত্যাচারিত। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোন রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। সুতরাং এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে হাজ্জাজ সিন্ধু জয় করে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন। ভারতে ইসলাম প্রচার করাও হাজ্জাজের একটি উদ্দেশ্য ছিল।
জলদস্যু কর্তৃক জাহাজ লুণ্ঠন
মুহম্মদ বিন কাসিম
অষ্টম শতকের শুরুতে বেশ কয়েকজন আরব বণিক শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) প্রাণত্যাগ করেন। শ্রীলংকার রাজা মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী দামেস্কে তাদের মৃতদেহ, পরিবার-পরিজন ও অর্থসামগ্রীসহ আটটি জাহাজে বোঝাই করে
প্রেরণ করেন। সাথে খলিফা এবং হাজ্জাজের জন্য কিছু উপহারও ছিল। সিন্ধুর বন্দর দেবলের (করাচির সন্নিকটে) কাছে এ সকল জাহাজ জলদস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়। হাজ্জাজ সিন্ধুর রাজা দাহিরের নিকট ক্ষতিপূরণ ও অপরাধীদের শাস্তির দাবি করেন। কিন্তু দাহির বলে পাঠান যে, জলদস্যুদের উপর তাঁর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সুতরাং তাঁর পক্ষে হাজ্জাজের দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। হাজ্জাজ এতে খুবই রেগে যান। তিনি দাহিরকে সমুচিত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি খলিফার নিকট থেকে সিন্ধু অভিযানের প্রয়োজনীয় অনুমতি গ্রহণ করেন।
সিন্ধু অভিযানের ঘটনা
ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন-ইউসুফ সিন্ধু বিজয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ ও বুদাইলের নেতৃত্বে পর পর দু'টি অভিযান পাঠালেন। কিন্তু দু'টি অভিযানই ব্যর্থ হল। এতে হাজ্জাজ ক্ষান্ত হলেন না। তিনি তৃতীয় অভিযান পাঠালেন। এই অভিযানের নেতৃত্ব দিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহম্মদ বিন-কাসিমকে। মুহম্মদ বিন-কাসিমের বয়স তখন মাত্র ১৭ (সতেরো) বছর। আগের দু'টি অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় এবার হাজ্জাজ ব্যাপক প্রস্তুতি নিলেন। মুহম্মদের সৈন্যবাহিনীতে ছিল প্রায় ৬০০০ পদাতিক, ৬০০০ উষ্ট্রারোহী, ৩০০০ তীরন্দাজ এবং ৩০০০ ভারবাহী পশু। তরুণ সেনানায়ক ছিলেন অসীম মনোবলের অধিকারী। নেতৃত্ব দেয়ার সকল গুণাবলীই তাঁর ছিল। মুহম্মদ মাকরানের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলেন। মাকরানের শাসকের সাথে তিনি বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। মাকরানের শাসক মুহম্মদকে আরও একটি সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করেন। রাজা দাহিরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জাঠ ও মেওয়াট গণ মুসলমানদের পক্ষে যোগ দেয়। হাজ্জাজ জলপথেও মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য একদল সৈন্য পাঠান। এছাড়া ‘বলিস্ত’ নামক একপ্রকার যন্ত্রও হাজ্জাজ পাঠিয়েছিলেন। বলিস্ত ছিল এক ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র। এই যন্ত্র দিয়ে ভারী পাথর দূরে নিক্ষেপ করে আঘাত করা সম্ভব ছিল।
মুহম্মদ বিন-কাসিম প্রথমেই দেবল বন্দর অবরোধ করেন। তিনি ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান সেনানায়ক। দেবলের প্রধান মন্দিরের চূড়ায় একটি লাল নিশান উড়ানো ছিল। তিনি বলিস্ত দিয়ে পাথর ছুড়ে নিশানটি ধ্বংস করে ফেলেন। এতে দেবলের সৈনিকদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তাদের ধারণা ছিল মন্দিরের চূড়ায় যতক্ষণ নিশান উড়বে ততক্ষণ বাইরের কোন শত্রু দেবল দখল করতে পারবে না। ব্রাহ্মণ ও রাজপুতগণ দেবল রক্ষার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালান। তাঁরা অসীম সাহসে যুদ্ধ করলেও শেষে মুসলমানদের উন্নত রণকৌশলের কাছে পরাজিত হলো। মুসলমানদের দখলে এলো দেবল বন্দর। দেবল দখলের পর মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু নদের তীর ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে নীরুন, সিওয়ান ও সিসাম শহরগুলো একের পর এক জয় করলেন। এগুলো দখল করতে তাঁকে তেমন কোন বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু রাওয়ার দুর্গ দখলের ব্যাপারে মুহম্মদ বিন কাসিমকে প্রচণ্ড বাঁধার মুখে পড়তে হয়। এখানে রাজা দাহির এক বিশাল সৈন্যবাহিনীর সমাবেশ ঘটান। মুহম্মদ বিন-কাসিম নৌকার সেতু তৈরি করে সিন্ধু নদ পার হন। অতঃপর দাহিরের বাহিনীর সাথে মুসলমানদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। রাজা দাহির বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ ত্যাগ করেন। রাজার মৃত্যুতে সৈনিকগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং সবাই পালিয়ে যায়। অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে দাহিরের বিধবা পত্নী রাণীবাঈ দুর্গে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু দুর্গ রক্ষা করা যাবেনা ভেবে তিনি অন্তঃপুরের অন্যান্য রমনীদের নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেন। শত্রুর হাতে অপমানিত হওয়ার ভয়ে এভাবে মৃত্যুকে বেছে নেয়ার রীতি তৎকালীন ভারতে প্রচলিত ছিল; একে হজব্রত বলা হতো। রাওয়ার দুর্গ দখলের পর মুহম্মদ বিন কাসিম ব্রাহ্মণাবাদ অধিকার করেন। এরপর সিন্ধুর রাজধানী আলোর দুর্গের পতন ঘটে। আলোর জয় করে তিনি সিন্ধু অঞ্চলে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। এরপর মুহম্মদ বিন কাসিম আরও উত্তরে অগ্রসর হয়ে মুলতান জয় করেন। মুলতানের পথে তিনি রাভী নদীর তীরে অবস্থিত উচ্ দখল করেন। মুলতান দখল করতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। মুলতান রক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে স্থানীয় যোদ্ধারা প্রায় দু'মাস মুলতান দুর্গ রক্ষায় সক্ষম হয়। অবশেষে তাদের সকল প্রতিরোধ চূর্ণ করে মুহম্মদ বিন-কাসিম মুলতান দখল করতে সক্ষম হন। মুলতান দখলের মধ্য দিয়ে রাজা দাহিরের রাজ্যের পুরোটাই মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে।
সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল
সিন্ধু বিজয়ের পর মুহম্মদ বিন কাসিম সেখানকার প্রশাসনিক দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ৭১২ থেকে ৭১৫ পর্যন্ত প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সিন্ধু-মুলতানে তিনি মুসলিম প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল ওয়ালিদের মৃত্যু হয়। পরবর্তী খলিফা সোলায়মান আল ওয়ালিদের আস্থাভাজন ও অনুগৃহীত ব্যক্তিদের প্রতি বিরূপ আচরণ শুরু করেন এবং তিনি মুহম্মদ বিন কাসিমকে দামেস্কে যেতে নির্দেশ পাঠান। সেখানে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়।
কারাগারেই তাঁর মৃত্যু হয়। মুহম্মদ বিন-কাসিমের অকাল মৃত্যুর ফলে তাঁর বিজয় অভিযান সিন্ধু ও মুলতানেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশেষত এ কারণেই মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। স্ট্যানলি লেনপুল মন্তব্য করেছেন, “ভারত ও ইসলামের ইতিহাসে আরবদের সিন্ধু বিজয় একটি উপাখ্যান মাত্র, এটি একটি নিষ্ফল বিজয়।” কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁর এই মন্তব্যকে সমর্থন করলেও কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।
রাজনৈতিক ফলাফল
একথা সত্য যে, মুহম্মদ বিন কাসিমের বিজয় শুধুমাত্র সিন্ধু ও মুলতানেই সীমাবদ্ধ ছিল । কিন্তু তাই বলে এ বিজয়কে নিষ্ফল বলা যায় না। আরবরা সিন্ধু অঞ্চলে এক উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। আরব সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই সিন্ধুতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন এবং কেউ কেউ স্থানীয় রমণীও বিয়ে করেন। এভাবে ভারতে স্থায়ী মুসলমান বসতি গড়ে ওঠে। তারা রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করে। আরব বংশধর ও হিন্দুগণ দীর্ঘকাল পাশাপাশি বসবাস করে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুহম্মদ বিন কাসিমের বিজয় সুলতান মাহমুদকে বারবার ভারত অভিযানে অনুপ্রাণিত করেছিল। সুলতান মাহমুদের পর মুহম্মদ ঘোরি ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করেন। তবে মুহম্মদ বিন-কাসিমের বিজয়কে ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ভারতে দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ফলাফল
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সিন্ধু বিজয়ের সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল লক্ষ্যণীয়। স্থানীয় অধিবাসীগণ মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার কারণে তারা ইসলামের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ দ্বারা আকৃষ্ট হয়। জাঠ ও মেওয়াটগণ মুসলমানদের স্বাগত জানিয়েছিল। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা এবং সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে অনেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতীয় সমাজের বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। এই বিজয়ের ফলে আরব সাম্রাজ্যের সাথে ভারতের ব্যবসায় বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয় এর ফলে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উপকূলে আরবদের সামুদ্রিক বাণিজ্য সুদূর প্রসারী হয়। ফলে দু'পক্ষই অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হয় ।
সাংস্কৃতিক ফলাফল
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে আরবগণ গ্রিক, মিসরীয়, মেসোপটেমীয় এবং পারসিক সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়। তারা এ সকল সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় সাধন করে। মুসলমানগণ যখন ভারতে আসে তখন তারা ছিল এই সমন্বিত সংস্কৃতি ও সভ্যতার অধিকারী। ভারতীয়রা দর্শন, সাহিত্য, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, সংগীত, চিত্রশিল্প প্রভৃতিতে প্রাচীনকাল থেকেই উন্নতি সাধন করেছিল। ভারতীয় সভ্যতা ও ইসলামি সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগের ফলে ভাবের আদান-প্রদান ও সংমিশ্রণ ঘটে। আব্বাসীয় যুগের খলিফাগণ ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই-পুস্তক আরবি ভাষায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা করে এক স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিলেন । উদাহরণ হিসেবে ‘সিন্দহিন্দ' নামক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়। খলিফা মনসুরের আমন্ত্রণে কয়েকজন ভারতীয় পন্ডিত বাগদাদ যাওয়ার সময় সাথে নিয়ে যান জ্যোতির্বিদ্যার উপর লিখিত ‘সিদ্ধান্ত' নামক সংস্কৃত গ্রন্থটি। আরবীয় পন্ডিতগণ এটি আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। অনূদিত গ্রন্থটির নামকরণ করা হয় ‘সিন্দহিন্দ’। ভারতীয়দের কাছ থেকেই আরবগণ গাণিতিক সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর লিখিত ‘চরক’ ও ‘সুশ্রুত’ আরবিতে অনূদিত হয়। ‘পঞ্চতন্ত্রের’ হিতোপদেশ আরবিতে অনূদিত হয়ে আরব ভূখন্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
পাঠ-১.৩
সুলতান মাহমুদ: সামরিক অভিযান, চরিত্র ও কৃতিত্ব
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের বিভিন্ন কারণসূমহ বর্ণনা করতে পারবেন;
সুলতান মাহমুদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি ও অভিযান প্রতিহতের বিবরণ দিতে পারবেন ও
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের পর্যায় ক্রমিক ফলাফল বিশ্লেষণ করতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
গজনী, ধনরত্ন, মুলতান ও রাজন্যবর্গ ও সোমনাথ মন্দির
ভূমিকা: সুলতান মাহমুদের অভিযানের কারণ
সুলতান মাহমুদ ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের প্রায় তিনশ বছর পর গজনির সুলতান মাহমুদ ভারত অভিযান করেন। গজনি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আলপ্তগীন। আলপ্তগীনের ক্রীতদাস ও জামাতা গজনীর আমির সবুক্তগীনের পুত্র ছিলেন সুলতান মাহমুদ। এ রাজবংশটি ইসলামের ইতিহাসে ‘গজনি রাজবংশ' নামে পরিচিত। সবুক্তগীনের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ইসমাইল সিংহাসনে বসেন। ইসমাইলকে পরাজিত ও কারারুদ্ধ করে মাহমুদ ক্ষমতা দখল করেন। তিনি আমির-এর পরিবর্তে সুলতান উপাধি ধারণ করেন। বাগদাদের খলিফা কাদির বিল্লাহ তাকে ‘ইয়ামিন-উদ-দৌলা’ ও ‘আমিন-উল-মিল্লাত' খেতাবে ভূষিত করেন। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি সতেরো বার ভারত অভিযান করেন। তাঁর এই অভিযানের কারণগুলোকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায় যথা: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয়। রাজনৈতিক কারণ
সুলতান মাহমুদের পিতা সবুক্তগীনের সময় থেকে গজনির সাথে পাঞ্জাবের হিন্দুশাহী বংশের বিরোধ চলছিল। পাঞ্জাবের হিন্দুশাহী রাজ্যের রাজা জয়পাল সবুক্তগীনের শত্রু হওয়ায় সুলতান মাহমুদ জয়পালের সাথে শত্রুতা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। ভারতের অনেক রাজা জয়পালের সাথে মাহমুদ বিরোধী জোটে যোগদান করেন। সুতরাং মাহমুদকে তাঁদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করতে হয়। আবার ভারতের কোন কোন রাজা মাহমুদের সাথে বন্ধুত্ব সূত্রে আবদ্ধ হয়। এতে তাঁদের প্রতিবেশী রাজন্যবর্গ তাঁদের প্রতি বৈরী আচরণ শুরু করেন। মিত্রবর্গের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যও মাহমুদকে ভারতে অভিযান করতে হয়। পরাজিত রাজারা মাহমুদের সাথে সন্ধি করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সুযোগ পেয়ে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেন। বিদ্রোহী রাজাদের সন্ধির শর্ত পালনে বাধ্য করার জন্যও মাহমুদকে অভিযান করতে হয়।
অর্থনৈতিক কারণ
সুলতান মাহমুদ রাজধানী গজনিকে তিলোত্তোমা নগরীতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানী-গুণীর পৃষ্ঠপোষক। তাঁর ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী। তিনি দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এসবের জন্য তাঁর প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। গজনীর রাষ্ট্রীয় কোষাগার তাঁর চাহিদার যোগান দিতে পারছিল না। তাই তিনি বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। তখন ভারত ছিল সম্পদশালী দেশ। এখানকার বিভিন্ন রাজ্যের কোষাগার ধনরত্নে পূর্ণ ছিল। ধর্মপ্রাণ বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ অকাতরে মন্দিরগুলোতে দান করতো। মন্দিরকে নিরাপদ বিবেচনা করে অনেক সময় রাজারাও তাতে ধনরত্ন সংরক্ষণ করতেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সুলতান মাহমুদের নজর ভারতের উপর পড়ে। এজন্য তিনি প্রায় প্রতি বছর ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন এবং ভারত থেকে প্রচুর ধন-রত্ন নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান। প্রফেসর হাবিব, প্রফেসর নাজিম ও হেইগ প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই বলে মাহমুদকে লুণ্ঠনকারী বা অর্থলোলুপ তস্কর বলা যাবে না। কারণ ভারত থেকে সংগৃহীত অর্থ তিনি মানব কল্যাণে ব্যয় করেন। নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য তিনি সে অর্থ ব্যবহার করেন নি ।
সামরিক উদ্দেশ্য
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি সামরিক উদ্দেশ্য ছিল। তাঁর রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধু দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। এ সকল অঞ্চল ছিল সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ সমরবিদ হিসেবে তাঁর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী ছিল সুশৃংঙ্খল ও সমরনিপুণ। তিনি বুঝতে পারেন এ সকল অঞ্চল জয় করতে তাঁকে খুব একটা বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে না। সুতরাং তিনি বার বার ভারত আক্রমণ করে তাঁর সামরিক উদ্দেশ্য হাসিল করেছিলেন।
ধর্মীয় উদ্দেশ্য
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের পশ্চাতে কোন কোন ঐতিহাসিক ধর্মীয় উদ্দেশ্যও কার্যকর ছিল বলে মনে করেন। তাঁদের মতে তিনি ভারতে ইসলাম প্রচারে অভিলাষী ছিলেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই মত সমর্থন করেন না। তাঁরা মনে করেন মাহমুদের যুগে শাসকগণ ইসলাম প্রচার করা তেমন কর্তব্য বলে মনে করতেন না। তিনি ভারত অভিযানে এসে কোন বিধর্মীকে বলপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেন নি। এছাড়া মাহমুদ হিন্দু মন্দির দখল করেছেন ধর্ম বিদ্বেষের কারণে নয়, বরং অর্থ পাওয়ার আশায়। এ সকল মন্দির ছিল যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত সম্পদে পূর্ণ। সর্বোপরি তাঁর সেনাবাহিনীতে হিন্দু সৈন্যের উপস্থিতি তার ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যকে অনুমোদন করে না।
সুলতান মাহমুদের প্রধান প্রধান অভিযান
সুলতান মাহমুদ ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাত্র ২৭ বছরে ১৭ বার ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযান পরিচালনা করেন। প্রথমে তিনি খাইবার গিরিপথের কয়েকটি দুর্গ দখল করেন। পিতা সবুক্তগীনের সময় থেকেই জয়পালের সাথে তাদের শত্রুতা চলে আসছিল। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের রাজা জয়পাল বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও পরাজিত হন। তিনি কয়েকজন পুত্র-পৌত্রসহ সুলতানের সৈন্যদের হাতে বন্দী এবং কয়েকটি শর্তে তিনি মুক্তি পান। নিজ পুত্র আনন্দপালের হাতে রাজ্যের ভার ছেড়ে দেন তিনি। অত:পর তিনি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জয়পালের পৌত্র সুখপাল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নতুন নাম হয় ‘নওশাহ’। ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ভীরা রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। এই রাজ্যের রাজা ছিলেন বিজয় রায়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিজয় রায় পলায়ন করেন। মুসলমান সৈন্যগণ তাঁর পিছু ধাওয়া করে। পলায়ন সম্ভব নয় বুঝতে পেরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ১০০৬ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ মুলতান আক্রমণ করেন। মুলতানের শাসনকর্তা ছিলেন আবুল ফতেহ দাউদ। দাউদ পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। মাহমুদ জয়পালের পুত্র নওশাহকে মুলতানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু সুলতান গজনীতে ফিরে যাওয়া মাত্র নওশাহ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন। সুলতান তাঁকে দমন করার জন্য আবার অভিযান পাঠান। এটি ছিল ভারতে তাঁর পঞ্চম অভিযান । নওশাহ পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ ভারতে তাঁর ষষ্ঠ অভিযান পরিচালনা করলে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা আনন্দপাল পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলোর রাজাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। উজ্জয়িনী, কালিঞ্জর, গোয়ালিয়র, কনৌজ, দিল্লি ও আজমীরের রাজাগণ এই আবেদনে ব্যাপক সাড়া দেন। হিন্দু রমণীগণ তাদের গায়ের গহনা ও অন্যরা সৈন্য ও অর্থ দিয়ে আনন্দপালকে সাহায্য করেন। আনন্দপাল এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মাহমুদের মুখোমুখি হন। ওয়াইহিন্দ নামক স্থানে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আনন্দপালের সম্মিলিত বাহিনীই সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। কিন্তু হঠাৎ আনন্দপালের হাতী ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। এতে তাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সুলতান মাহমুদ বিজয়ী হয়ে পাঞ্জাব থেকে প্রচুর ধন-রত্ন গজনীতে নিয়ে যান। পাঞ্জাবকে তিনি নিজ রাজ্যভুক্ত করেন।
মাহমুদ ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিলোচনপালের রাজধানী নন্দনা আক্রমণ করেন। এটি ছিল তাঁর নবম অভিযান। যুদ্ধে হেরে গিয়ে ত্রিলোচনপাল কাশ্মীরে পলায়ন করেন। কাশ্মীরের রাজা তুঙ্গ তাঁকে আশ্রয় দেন। মাহমুদের সাথে তাঁদের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধেও মাহমুদ জয়ী হন। সুলতান গজনীতে ফিরে গেলে ত্রিলোচনপাল পাঞ্জাবে ফিরে আসেন। তিনি শিবলী পাহাড়ে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। বুন্দেলখন্ডের রাজা বিদ্যাধরের সাথে তিনি মৈত্রী চুক্তি করেন। মাহমুদ তাঁকে এই চুক্তি ভঙ্গ করতে বলেন। কিন্তু ত্রিলোচন এতে রাজী হন নি। মাহমুদ তাই তার বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান প্রেরণ করেন। এবার মাহমুদ পাঞ্জাব দখল করে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি নিজের একজন আমিরকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সুলতান মাহমুদের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালিত হয় কনৌজের বিরুদ্ধে । এটি ছিল তাঁর ১২তম অভিযান। কনৌজ ভারতের কেন্দ্রিয় শক্তি হিসেবে বিবেচিত ছিল। রাজ্যপাল ছিলেন সে-সময় কনৌজের রাজা। মাহমুদ ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে
ছিলেন, সুলতান মাহমুদের দরবারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে গ্রন্থটি আল বিরুনীকে ইতিহাসে বিখ্যাত করে রেখেছে তা হলো ‘কিতাব-উল-হিন্দ'। ঈশ্বরী প্রসাদ সুলতান মাহমুদের যুগকে কবিতার যুগ বলে অভিহিত করেছেন। ঐ যুগের প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন আবুল কাশেম ফেরদৌসী। প্রাচ্যের হোমার নামে খ্যাত এ কবি সুলতান মাহমুদের অনুরোধে জগদ্বিখ্যাত ‘শাহনামা' মহাকাব্য রচনা করেন।
শিক্ষার্থীর কাজ
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের সাংস্কৃতিক ফলাফল শ্রেণি কক্ষে আলোচনা করুন ৷
সারসংক্ষেপ:
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের প্রভাব সমগ্র উত্তর ভারতে অনুভূত হয়। পাঞ্জাবের কিয়দংশ এবং মুলতান ছাড়া ভারতের আর কোন অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় নি। সুলতান মাহমুদের এ বিজয়ই পরবর্তীকালে মুসলমানদের ভারত বিজয়ের পথ সুগম করেছিল। সুলতান মাহমুদের বার বার আক্রমণ উত্তর ভারতের রাজন্যবর্গ সামরিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন বলে পরবর্তী মুসলমান আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভবপর হয় নি। ঈশ্বরী প্রসাদ তাঁকে ‘বড় মাপের দ্বিগ্বিজয়ী বীর' বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুলতান মাহমুদ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আল বিরুনীর বিখ্যাত ‘কিতাব-উল-হিন্দ' ও কবি আবুল কাশেম ফেরদৌসীর জগদ্বিখ্যাত 'শাহনামা' মহাকাব্য ।
পাঠ-১.৫
মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘোরির চরিত্র ও কৃতিত্ব
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
মুহম্মদ ঘোরি কর্তৃক বিজিত এলাকা সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন; মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘোরির চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারবেন ও
মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘোরির কৃতিত্ব বিশ্লেষণ করতে পারবেন ।
মূখ্য শব্দ
মুলতান, আনহিলওয়ার, কনৌজ ও বারাণসী
ভূমিকা: মুহম্মদ ঘোরি ভারতে অনেকগুলো অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি দিল্লি ও এর আশেপাশের এলাকা দখল করেন এবং ভারতে সর্বপ্রথম স্থায়ীভাবে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব অর্জন করেন। মুহাম্মদ ঘুরি ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে একজন শিয়া আততায়ীর হাতে নিহত হন। তাঁর নিকট শত্রু-মিত্র সকলেই ন্যায় বিচার পেতেন। জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে তিনি সকলের প্রতি ন্যায়বিচার করতেন। মানুষ হিসেবে তিনি আকর্ষনীয় চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল দৃঢ় মনোবল, আত্মপ্রত্যয়, ধর্মনিষ্ঠা, সত্যবাদিতা ও দানশীলতা ইত্যাদি। সততা ও বিশ্বস্ততা ছিল তার চরিত্রের উজ্জ্বল দিক । জেষ্ঠ্য ভ্রাতা গিয়াস উদ্দিনের প্রতি তাঁর আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা ইতিহাসে তাঁকে উচ্চ স্থানে উন্নীত করেছে। এজন্যই হয়তো ঐতিহাসিক আবুল কাশিম ফিরিস্তা তাকে আল্লাহভীরু, সত্যনিষ্ঠ এবং প্রজারঞ্জক সুলতান হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি দয়ালু ও ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শিক্ষা, সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল ।
মুহম্মদ ঘোরির চরিত্র ও কৃতিত্ব
মুহম্মদ ঘোরি ছিলেন একজন বিজেতা। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। তিনি সুচতুর ও অধ্যবসায়ী ছিলেন। কোন ব্যর্থতা কোনদিন তাঁকে দমাতে পারেনি। তাঁর মনোবল ও সংগঠনী শক্তি ছিল অসাধারণ। অন্য ধর্মের লোকের প্রতিও তিনি সদয় আচরণ করতেন। বড় ভাইয়ের প্রতি তিনি যে আনুগত্য দেখান ইতিহাসে তার দৃষ্টান্তবিরল। তিনি দয়ালু ও ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শিক্ষা, সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। তিনি ভারতে স্থায়ী মুসলমান শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন। সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর স্থান ইতিহাসে অম্লান। মুহম্মদ ঘোরির অভিযানের ফলে ভারতের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। নতুন অঞ্চল বিজিত হওয়ায় মুসলমান শিক্ষাবিদ, ধর্মপ্রচারক ও শিল্পীগণ নতুন ও বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রের সন্ধান পান। অনেক ধর্মীয় নেতা ও সুফি দরবেশ এদেশে আসেন। তাঁরা ধর্মপ্রচারে ব্রতী হন। বিজিত অঞ্চলে মক্তব, মাদ্রাসা ও খানকাহ্ গড়ে উঠতে থাকে। মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে নতুন সভ্যতার সূচনা করে। ভারতীয় স্থাপত্যরীতিতেও সাধিত হয় ব্যাপক পরিবর্তন। মুসলিম বিজেতাগণ প্রয়োজনের তাগিদে এবং ইসলামের
গৌরব প্রকাশের জন্য সুদৃশ্য ইমারত, মসজিদ ও মিনার নির্মাণ করেন। এ সকল স্থাপত্য নির্মাণে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহৃত ও শ্রমিক নিয়োজিত হয় এবং ফলে ভারতীয় ও মুসলিম স্থাপত্য কৌশলের সংযোজন ঘটে।
রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিষ্ঠাতা:
মুহম্মদ ঘোরি ছিলেন একজন দূরদর্শী ও বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন রাজনীতিবিদ। লক্ষ্য ছিল তাঁর ভারতে স্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার। ভারতের বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ ও কোনো পরাজয়ে হতোদ্যম না হয়ে তিনি লক্ষ্য বাস্তবায়নে স্থির ছিলেন। এজন্য তিনি বাঙলা থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তিনি শুধু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে ইতিহাসে পরিচিতি হন নি বরং একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়সংগত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন যা তাকে ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে।